বাংলা কবিতা
--মানসী
__ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী !
পুরুষ গড়েছে তোমারে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে । বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন ।
সঁপিয়া তোমার 'পরে নূতন মহিমা
অমর করেছে শিল্পী তোমার প্রতিমা ।
কত বর্ণ, কত গন্ধ, ভূষণ কত-না --
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে, খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার ।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন ।
পড়েছে তোমার 'পরে প্রদীপ্ত বাসনা --
অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা
=================================
তুমি না থাকলে সকালটা এতো মিষ্টি হতো না
তুমি না থাকলে মেঘ করে যেত বৃষ্টি হতো না
তুমি না থাকলে মন কষাকষি, করে হাসাহাসি নাক ঘষাঘষি
রাপা রাপপাপপা রাম পাম পা।
তুমি না থাকলে চাঁদটার গায়ে পড়ে যেত মরচে
তুমি না থাকলে কিপটে লোকটা হতো না যে খরচে
তুমি না থাকলে স্বপ্নের রং হয়ে যেত খয়েরী
বনবন করে দুনিয়াটা এই পারতো না ঘুরতে
তুমি না থাকলে রবীন্দ্রনাথ কালির দোয়াত মাথায় ঠুকে হতো কুপোকাত
রাপা রাপপাপপা রাম পাম পা।
তুমি না থাকলে সুমন কেলেঙ্কারী করতো কত
গীটার ফেলে গুয়েতেমালায় নামটা শেখাতে হতো
পাশের বাড়ির মেয়েটা পাশের পাড়ার ছেলের সাথে
তুমি না থাকলে এইভাবে কি বাড়িটা ছেড়ে পালাতো
তুমি না থাকলে তাজমহলটা বানানোই হতো না
লাঠালাঠি এই কাটাকাটি কিছু থামানোই যেত না
তুমি না থাকলে মোনালিসা কবে হয়ে যেত গম্ভীর
তুমি না থাকলে তোমার চিঠি জমানোই হতো না
তুমি না থাকলে রোমিও কবে
হোমিওপ্যাথির দোকান খুলে জমিয়ে দিতো
রাপা রাপপাপপা রাম পাম পা
============================================
কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে
জোনাকীর আলো নেভে আর জ্বলে
শাল মহুয়ার বনে।।
কবিতার সাথে চৈতী রাতে
কেটেছে সময় হাত রেখে হাতে
সেই কথা ভেবে পিছু চাওয়া মোর
স্মৃতির নকশা বুনে।।
অতীতের ছবি আঁকা হয়ে গেলে
চারিদিকে এই চোখ দুটি মেলে
পলাতক আমি কোথা যেন যাই
আঁধারের রিদন শুনে।।
=========================================
চাই না কোথাও যেতে
- মহাদেব সাহা---যদুবংশ ধ্বংসের আগে
আমি তো তোমাকে ফেলে চাই না কোথাও যেতে
পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা মনোরম স্থানে,
সমুদ্র-সৈকতে, স্বর্ণদ্বীপে-
স্বপ্নেও শিউরে উঠি যখন দেখতে পাই
ছেড়ে যাচ্ছি এই মেঠো পথ, বটবৃক্ষ, রাখালের
বাঁশি, হঠাৎ আমার বুকে আছড়ে পড়ে পদ্মার ঢেউ
আমার দুচোখে শ্রাবণের নদী বয়ে যায়;
যখন হঠাৎ দেখি ছেড়ে যাচ্ছি সবুজ পালের নৌকো,
ছেড়ে যাচ্ছি ঘরের মেঝেতে আমার মায়ের আঁকা
সারি সারি লক্ষ্মীর পা
বোবা চিৎকারে আর্তকণ্ঠে বলে উঠি হয়তো
তখনই-
তোমার বুকের মধ্যে আমাকে লুকিয়ে রাখো
আমি এই মাটি ছেড়ে, মাটির সান্নিধ্য ছেড়ে,
আকাশের আত্মীয়তা ছেড়ে,
চাই না কোথাও যেতে, কোথাও যেতে
--মন ভালো নেই
- মহাদেব সাহা
বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুলকরে চলে যায়, এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকবো শূন্যতার দিকে?
এই শূন্য ঘরে, এই নির্বসনে
কতোকাল, আর কতোকাল!
আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি,
উদ্যানে উঠেচে ক্যাকটাস্
কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,
শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস, এই দীর্ঘ পদধ্বনি।
টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত
ডাকতে ডাকতে একশেষ;
কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না
এই হিমঘরে ভাঙা চেয়ারে একা বসে আছি।
এ কী শান্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশ্বর,
এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা!
তবু মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, আমি বেঁচে থাকতে চাই
আমি ভালোবাসতে চাই, পাগলের মতো
ভালোবাসতে চাই-
এই কি আমার অপরাধ!
আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই;
তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার
কথা ছিল-
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
ফুল ফোটানো কথা ছিলো
সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না;
আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত
শুধু হাহাকার
শুধু শূন্যতা, শূন্যতা।
তোমার শূন্য পথের দিকে তাকাতে তাকাতে
দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো,
সব নদীপথ বন্ধ হলো, তোমার সময় হলো না-
আজ সারাদিন বিষাদপর্ব, সারাদিন তুষারপাত-
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই।
--চিঠি দিও
--মহাদেব সাহা
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।
চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও ...
বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!
আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ....
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! ...
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি
=================================================
---তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশী ভালোবেসে ফেলি
– মহাদব সাহা
তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই
এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;
তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ জড়িয়ে যাই আমি
আমার কিছুই আর করার থাকে না
তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে যেতে চাই
যদি ডুবে যেতে চাই তুমি দুহাতে জাগাও।
এমন সাধ্য কী আছে তোমার চোখের সামান্য আড়াল হই,
দুই হাত দূরে যাই
যেখানেই যেতে চাই সেখানেই বিছিয়ে রেখেছো ডালপালা,
তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনও সম্ভব
তুমি সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
আকাশের চেয়েও আকাশ তুমি আমার ভেতরে জেগে আছো।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো বেশি
ভালোবেসে ফেলি,
তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে আরো কাছে টেনে নেই
যতোই তোমার কাছ থেকে আমি দূরে যেতে চাই
ততো মিশে যাই নি:ম্বাসে প্রশ্বাসে,
ততোই তোমার আমি হয়ে পড়ি ছায়ার মতন;
কোনোদিকে যাওয়ার আর একটুও জায়গা থাকে না
তুমিই জড়িয়ে রাখো তোমার কাঁটায়।
তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আরো জড়িয়েছি
তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো ভালোবেসেছি
তোমাকে।
==============================================================
---মেঘ দেখার দুঃখ, গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা
– মহাদেব সাহা
কী করে বলি এই মেঘ দেখর দুঃখ, এই গোলাপ দেখার
ব্যাকুলতা-
কিন্তু আমিও যখন মেঘের দিকে তাকাই দেখি কালিদাসই
দেখছেন বিরহী যক্ষকে,
হঠাৎ মন ভরে যায় বহু যুগের ওপার থেকে আসা বর্ষণে:
এই গোলাপ দেখর কথা আমার হয়তো বলাই হবে না
কিন্তু যখান গোলাপের দিকে তাকাই দেখি ব্রেক
তাকিয়ে আছেন গেলোপের রুগ্নতার দিকে,
কিংবা রিলকে আয়ত্ত করে চলেছেন একটি শ্বেতগোলাপ,
কী করে বলি এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!
মেঘ দেখতে দেখতে আমি যে কখন মেঘদূতের ভেতর ডুবে যাই,
বিরহকাতর যক্ষের জন্য ভারী হয়ে ওঠে এই বুক
কিংবা গোলাপের দিকে তাকাতেই চোখে ভেসৈ ওঠে
রিলকের মুখটি,
এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা
কাউকে বলাই হবে না ;
আমি যখন এই প্রকৃতির দিকে তাকাই দেখি রবীন্দ্রনাথ
দেখছেন প্রকৃতির নীলাম্বরী
সেই ব্যকুল বসন্তে আমারও দুচোখ জলে ভরে যায় -
এই মেঘ, এই গোলাপ আমারও অলিখিত কবিতা।
যখন মানুষের সুদ্ধতার কথা ভাবি দেখি দাঁড়িয়ে আছেন
ব্যথিত বোদলেয়ার
শহরের রাত্রির দিকে তাকালে মনে হয় জীবনানন্দ দাশ দেখছেন
লিবিয়ার জঙ্গল,
যখন একজন বিপ্লবীর দিকে তাকাই দেখি দুচোখে
মায়াকোভস্কির স্বপ্ন
আর্ত স্বদেশের দিকে তাকিয়ে আমিও নেরুদার কথাই ভাবি,
কেউ জানে না একটি ফুলের মৃত্যু দেখে, একটি পাখির ক্রন্দন দেখে
আমারও হৃদয় পৃথিবীর আহত কবিদের মতোই হাহাকার
করে ওঠে।
একটি ফুল দেখে আমিও একজন প্রেমিকের মতোই পরাজিত
হতে ভালোবাসি
একটি ঝরাফুলের দুঃখ বুকে নিয়ে যে-কোনো ব্যথিত কবির
মতোই সারাদনি ঘুরে বেড়াই,
আসলে সে-কথাগুলোই বলা হয়নি, বলা হয়নি;
মানুষের সমাজে এই বৈষম্য দেখে আমিও একজন
বিপ্লবীর মতোই শ্রেনীসংগ্রামের জন্য তৈরি হই,
এই জরা বার্ধক্য দেখে কতোবার বুদ্ধের মতোই
ব্যথিত হয়ে উঠি;
কিন্তু কী করে বলবো এইসব মেঘ দেখার দুঃখ, এইসব
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!
=============================================================
--এই জীবনে
– মহাদেব সাহা
এই জীবনে হবে না আর মূলে যাওয়া,
চুড়োয় ওঠা-
কাটবে জীবন পাদদেশে, পাদমূলে;
খুব ভেতরে প্রবেশ করা হবে না আর এই জীবনে
হবে না আর ভেতর মধু ফের আহরণ,
হবে শুধুই ওপর ছোঁয়া, ওপর দেখা।
এই জীবনে হবে না আর তোমার নিবিড়
স্পর্শ পাওয়া,
হবে না এই নদী দেখা, জলাশয়ের
কাছে যাওয়া,
একটিবার তোমায় নিয়ে হ্রদের জলে একটু নামা-
হবে না আর পৌঁছা মোটেই ডুব-সাঁতারে
জলের গহীন তলদেশে,
জলে নামা, সাঁতার শেখা;
মূলের সঙ্গে হবে না আর ঠিক পরিচয়
মাত্র এখন অনুবাদের অর্ধ স্বাদেই তৃপ্ত থাকা,
এই জীবনে হবে না আর আকাশ দেখা,
চিবুক ছোঁয়া-
তোমায় নিয়ে নীল পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া;
এই জীবনে হবে না আর তোমার গোপন দেখা পাওয়া,
একন শুধু চোখের জলে দুঃখ পাওয়া,
নিজের মাঝেই ফুরিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া।
এই জীবনে হবে না আর দুঃখ কারো
মোচন করা,
কারো অশ্রু মুছিয়ে দেয়া সাঁকো বাঁধা,
কারো ক্ষত সারিয়ে তোলা;
এই জীবনে হবে না আর মুগ্ধ ভ্রমণ,
কারো ক্ষত সারিয়ে তোলা;
এই জীবনে হবে না আর মুগ্ধ ভ্রমণ,
মূলে যাওয়া-
তোমায় ছোঁয়া।
===================================================
--এই জীবন
- মহাদেব সাহা-
এই একরত্তি জীবনে বলো না কীভাবে সম্ভব ভালোবাসা
তার জন্য চাই আরো দীর্ঘ অনন্ত জীবন,
ভালোবাসা কীভাবে সম্ভব, অতিশয় ছোটো এ জীবন
একবার প্রিয় সম্বোধন করার আগেই
শেষ হয় এই স্বল্প আয়ু-
হয়তো একটি পরিপূর্ণ চুম্বনেরও সময় মেলে না
করস্পর্শ করার আগেই নামে বিচ্ছেদের কালো যবনিকা;
এতো ছোটো সামান্য জীবনের কীভাবে হবেই ভালোবাসা
ভালোবাসি কথাটি বলতেই হয়তোবা কেটে যাবে সমস্ত জীবন,
হয়তোবা তোমার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই
লেগে যাবে অনেক বছর
হয়তো তোমার কাছে একটি প্রেমের চিঠি লিখতেই
শেষহয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ নিদ্রাহীন রাত;
তোমার সম্মুখে বসে প্রথম একটি শব্দ উচ্চারণ করতেই
শেষ হয়ে যাবে কতো কৈশোর-যৌবন,
ঘনাবে বার্ধক্য, কেশরাজি উড়াবে মাথায়
সেই ধূসর পতাকা;
এইটুকু ছোট্ট জীবন, এখানে সম্ভব নয় ভালোবাসা
তার জন্য চাই আরো অনেক জীবন, অনন্ত সময়
তোমাকে ভালোবাসার জন্য জানি তাও খুবই স্বল্প ও সংক্ষিপ্ত মনে হবে।
===================================================
---ঘুমোবার আগে
--- আবুল হাসান
আমার কাছে আগুন ছিলো না
আমি চাঁদের আগুনে
শাদা সিগ্রেট জ্বালিয়ে বসেছিলাম কুয়াশায়!
-কে ওখানে?
শীতরাতে পৌষ-পাখির গলা শোনা গেলো জ্যোত্স্নায়,
-কে ওখানে?
পাখির কন্ঠের গানে
কুয়াশায় আমি কালো জ্যোত্স্না ঘুরে হঠাত্ তখন
চাঁদের আগুনে পুড়ে
ছুঁয়ে দিতে উদ্যত হলাম!
অপসৃয়মাণ তুমি?
তোমাকে না ছুঁতে পেরে
আমি নিজ নিয়তির অন্তর্গত রোদনকে বললাম, দেখো
আমি আর কাঁদতে পারবো না !...
==========================================
চাই না কোথাও যেতে
- মহাদেব সাহা---যদুবংশ ধ্বংসের আগে
আমি তো তোমাকে ফেলে চাই না কোথাও যেতে
পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা মনোরম স্থানে,
সমুদ্র-সৈকতে, স্বর্ণদ্বীপে-
স্বপ্নেও শিউরে উঠি যখন দেখতে পাই
ছেড়ে যাচ্ছি এই মেঠো পথ, বটবৃক্ষ, রাখালের
বাঁশি, হঠাৎ আমার বুকে আছড়ে পড়ে পদ্মার ঢেউ
আমার দুচোখে শ্রাবণের নদী বয়ে যায়;
যখন হঠাৎ দেখি ছেড়ে যাচ্ছি সবুজ পালের নৌকো,
ছেড়ে যাচ্ছি ঘরের মেঝেতে আমার মায়ের আঁকা
সারি সারি লক্ষ্মীর পা
বোবা চিৎকারে আর্তকণ্ঠে বলে উঠি হয়তো
তখনই-
তোমার বুকের মধ্যে আমাকে লুকিয়ে রাখো
আমি এই মাটি ছেড়ে, মাটির সান্নিধ্য ছেড়ে,
আকাশের আত্মীয়তা ছেড়ে,
চাই না কোথাও যেতে, কোথাও যেতে
=======================================
- মানুষ
-- কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সল কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
'পূজারী, দুয়ার খোল,
ক্ষুদার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!'
স্বপ্ন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ'য়ে যাবে নিশ্চয়!
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুদায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, 'দ্বার খোল বাবা, খাইনি তো সাত দিন!'
সহসা বন্ধ হ'ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুদার মানিক জ্বলে!
ভুখারী ফুকারি' কয়,
'ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমারনয়!'
মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে-আজারির চিন্
বলে 'বাবা, আমি ভুকা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!'
তেরিয়াঁ হইয়া হাঁকিল মোল্লা -"ভ্যালা হ'ল দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?"
ভুখারী কহিল, 'না বাবা!' মোল্লা হাঁকিল - তা' হলে শালা
সোজা পথ দেখ!' গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
"আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুদার অন্ন তা'বলে বন্ধ করোনিপ্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!"
============================================
~কাজী নজরুল ইসলাম
খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট শিশুর আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
শূণ্যে মহা আকাশে
তুমি মগ্ন লীলা বিলাসে
ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
তারকা রবি শশী
খেলনা তব হে উদাসী
পড়িয়া আছে রাঙা
পায়ের কাছে রাশি রাশি।
নিত্য তুমি হে উদার
সুখে-দুখে অবিকার।
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন সনে
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
~এক আল্লাহ জিন্দাবাদ
~কাজী নজরুল ইসলাম
উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।
উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই;
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!
ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে,
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে।
ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে,
ওরা জিন, প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে।
মোরা বাংলার নব যৌবন,মৃত্যুর সাথে সন্তরী,
উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি।
মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী,
অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী।
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি।
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি।
উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার,
ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুলবাহার!
আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব
ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব।
হুতুম প্যাচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়,
কাকে আর তাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়।
বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি;
তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি।
তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে এক সাথে,
নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধুলির দুনিয়াতে।
সাত আসমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়,
আল্লা নিত্য মহাদানী প্রভূ, যে যাহা চায়, সে তাহা পায়।
যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই,
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই।
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মেরা আল্লার রাজ্য চাই,
দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই।
মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভূ মোদের,
শকুন শিবার মত কাড়াকাড়ি করে শবে লয়ে-- শখ ওদের!
আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভূ,
নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভূ।
পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক, ভালো হোক ভালো,
এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো।
সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে,
তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে।
দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী, তারা গুন্ডাদল
তারা দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল।
ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ চায়,
ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!
তাড়াবে এদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা,
এরাই বৈশ্য, ফসল শৈস্য লুটে খায়, এরা চির চেনা।
ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ,
পর ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর ঢেউ।
বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিঃশ্বাসে দিনে রাতে,
হবে দুলদুল - আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে।
আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন,
তাহারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন।
নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান
সর্ব-ক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান!
ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে - ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ,
মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব - "এক আল্লাহ জিন্দাবাদ"।
===================================================
শুদ্ধ করো আমার জীবন
~মহাদেব সাহা
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন,
আমি প্রতিটি ভোরের
মতো
আবার নতুন হয়ে উঠি,
হই সূর্যোদয়
আমার জীবন তুমি পরিশুদ্ধ করো,
আমি প্রস্ফুটিত হই
আমি বহুদিন ঝরা ব্যথিত বকুল অন্ধকারে,
আমি বহুদিন
বিষন্ন বিধুর ;
একবার আমার মাথায় হাত রাখো, সুপ্রসন্ন হও
এই দগ্ধ বুকে করো শ্রাবণের অঝোর বর্ষণ
আমি শ্যামল সবুজ বৃক্ষ হয়ে উঠি ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি হই
সূর্যোদয়,
আমি হই উদিত আকাশ
আমি হয়ে উঠি প্রতিটি শিশুর হাতে প্রথম
বানান
শেখা বই,
হয়ে উঠি ভোরবেলাকার পাখিদের গান ;
আমার জীবন তুমি শুদ্ধ করো, আমি হই নতুন
সবুজ
কোনো দ্বীপ,
আমি হই বর্ষাকাল, আমি হই বরষার নব
জলধারা
আমি বহুদিন ব্যথিত বিষাদ, আমি বহুদিন একা
ঝাউবন ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন,
আমি হয়ে উঠি সদ্যফোটা ফুল
আমি হয়ে উঠি সকালের ঘুমভাঙ্গা চোখ ।
===========================================
কতদিন দেহিনা মায়ের মুখ
হুনিনা সেই কোকিল নামের কালা পাহির গান
হায়রে পরান, হায়রে পরান।।
হায়রে আমার গাঁয়ের বাড়ি
সারি সারি গরুর গাড়ি
মরা নদীর চর।
দীঘির জলে হাসের খেলা
ঘরের চালে দুপুর বেলা
রঙ্গিলা কইতর।।
উঠানে চরাইনা সোনার ধান
হায়রে পরান, হায়রে পরান ।
কতদিন ধরিনা ডোবায় মাছ
করিনা সেই মরা নদীর মিঠা পানি পান
হায়রে পরান, হায়রে পরান ।
হায়রে আমার রখাল হিয়া
কাজলা গরুর গোসল দিয়া
মাঠে নিয়া যায়।
বিহাল বেলা বাঁশের বনে
ঝিকিমিকি রইদের সনে
মন মিলাইতে চায়।।
ভুলিতে পারেনা মাটির টান
হায়রে পরান, হায়রে পরান।
কতদিন রাহিনা চানের খোজ
দেহিনা সেই তারার চোখে মিছা অভিমান
হায়রে পরান, হায়রে পরান।
হায়রে পরান, হায়রে পরান।
হায়রে পরান, হায়রে পরান।
হায়রে পরান, হায়রে পরান।।
__ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী !
পুরুষ গড়েছে তোমারে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে । বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন ।
সঁপিয়া তোমার 'পরে নূতন মহিমা
অমর করেছে শিল্পী তোমার প্রতিমা ।
কত বর্ণ, কত গন্ধ, ভূষণ কত-না --
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে, খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার ।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন ।
পড়েছে তোমার 'পরে প্রদীপ্ত বাসনা --
অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা
=================================
তুমি না থাকলে সকালটা এতো মিষ্টি হতো না
তুমি না থাকলে মেঘ করে যেত বৃষ্টি হতো না
তুমি না থাকলে মন কষাকষি, করে হাসাহাসি নাক ঘষাঘষি
রাপা রাপপাপপা রাম পাম পা।
তুমি না থাকলে চাঁদটার গায়ে পড়ে যেত মরচে
তুমি না থাকলে কিপটে লোকটা হতো না যে খরচে
তুমি না থাকলে স্বপ্নের রং হয়ে যেত খয়েরী
বনবন করে দুনিয়াটা এই পারতো না ঘুরতে
তুমি না থাকলে রবীন্দ্রনাথ কালির দোয়াত মাথায় ঠুকে হতো কুপোকাত
রাপা রাপপাপপা রাম পাম পা।
তুমি না থাকলে সুমন কেলেঙ্কারী করতো কত
গীটার ফেলে গুয়েতেমালায় নামটা শেখাতে হতো
পাশের বাড়ির মেয়েটা পাশের পাড়ার ছেলের সাথে
তুমি না থাকলে এইভাবে কি বাড়িটা ছেড়ে পালাতো
তুমি না থাকলে তাজমহলটা বানানোই হতো না
লাঠালাঠি এই কাটাকাটি কিছু থামানোই যেত না
তুমি না থাকলে মোনালিসা কবে হয়ে যেত গম্ভীর
তুমি না থাকলে তোমার চিঠি জমানোই হতো না
তুমি না থাকলে রোমিও কবে
হোমিওপ্যাথির দোকান খুলে জমিয়ে দিতো
রাপা রাপপাপপা রাম পাম পা
============================================
কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে
জোনাকীর আলো নেভে আর জ্বলে
শাল মহুয়ার বনে।।
কবিতার সাথে চৈতী রাতে
কেটেছে সময় হাত রেখে হাতে
সেই কথা ভেবে পিছু চাওয়া মোর
স্মৃতির নকশা বুনে।।
অতীতের ছবি আঁকা হয়ে গেলে
চারিদিকে এই চোখ দুটি মেলে
পলাতক আমি কোথা যেন যাই
আঁধারের রিদন শুনে।।
=========================================
চাই না কোথাও যেতে
- মহাদেব সাহা---যদুবংশ ধ্বংসের আগে
আমি তো তোমাকে ফেলে চাই না কোথাও যেতে
পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা মনোরম স্থানে,
সমুদ্র-সৈকতে, স্বর্ণদ্বীপে-
স্বপ্নেও শিউরে উঠি যখন দেখতে পাই
ছেড়ে যাচ্ছি এই মেঠো পথ, বটবৃক্ষ, রাখালের
বাঁশি, হঠাৎ আমার বুকে আছড়ে পড়ে পদ্মার ঢেউ
আমার দুচোখে শ্রাবণের নদী বয়ে যায়;
যখন হঠাৎ দেখি ছেড়ে যাচ্ছি সবুজ পালের নৌকো,
ছেড়ে যাচ্ছি ঘরের মেঝেতে আমার মায়ের আঁকা
সারি সারি লক্ষ্মীর পা
বোবা চিৎকারে আর্তকণ্ঠে বলে উঠি হয়তো
তখনই-
তোমার বুকের মধ্যে আমাকে লুকিয়ে রাখো
আমি এই মাটি ছেড়ে, মাটির সান্নিধ্য ছেড়ে,
আকাশের আত্মীয়তা ছেড়ে,
চাই না কোথাও যেতে, কোথাও যেতে
--মন ভালো নেই
- মহাদেব সাহা
বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুলকরে চলে যায়, এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকবো শূন্যতার দিকে?
এই শূন্য ঘরে, এই নির্বসনে
কতোকাল, আর কতোকাল!
আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি,
উদ্যানে উঠেচে ক্যাকটাস্
কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,
শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস, এই দীর্ঘ পদধ্বনি।
টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত
ডাকতে ডাকতে একশেষ;
কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না
এই হিমঘরে ভাঙা চেয়ারে একা বসে আছি।
এ কী শান্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশ্বর,
এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা!
তবু মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, আমি বেঁচে থাকতে চাই
আমি ভালোবাসতে চাই, পাগলের মতো
ভালোবাসতে চাই-
এই কি আমার অপরাধ!
আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই;
তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার
কথা ছিল-
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
ফুল ফোটানো কথা ছিলো
সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না;
আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত
শুধু হাহাকার
শুধু শূন্যতা, শূন্যতা।
তোমার শূন্য পথের দিকে তাকাতে তাকাতে
দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো,
সব নদীপথ বন্ধ হলো, তোমার সময় হলো না-
আজ সারাদিন বিষাদপর্ব, সারাদিন তুষারপাত-
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই।
--চিঠি দিও
--মহাদেব সাহা
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।
চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও ...
বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!
আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ....
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! ...
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি
=================================================
---তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশী ভালোবেসে ফেলি
– মহাদব সাহা
তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই
এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;
তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ জড়িয়ে যাই আমি
আমার কিছুই আর করার থাকে না
তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে যেতে চাই
যদি ডুবে যেতে চাই তুমি দুহাতে জাগাও।
এমন সাধ্য কী আছে তোমার চোখের সামান্য আড়াল হই,
দুই হাত দূরে যাই
যেখানেই যেতে চাই সেখানেই বিছিয়ে রেখেছো ডালপালা,
তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনও সম্ভব
তুমি সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
আকাশের চেয়েও আকাশ তুমি আমার ভেতরে জেগে আছো।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো বেশি
ভালোবেসে ফেলি,
তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে আরো কাছে টেনে নেই
যতোই তোমার কাছ থেকে আমি দূরে যেতে চাই
ততো মিশে যাই নি:ম্বাসে প্রশ্বাসে,
ততোই তোমার আমি হয়ে পড়ি ছায়ার মতন;
কোনোদিকে যাওয়ার আর একটুও জায়গা থাকে না
তুমিই জড়িয়ে রাখো তোমার কাঁটায়।
তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আরো জড়িয়েছি
তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো ভালোবেসেছি
তোমাকে।
==============================================================
---একটা কোনো সুসংবাদ চাই
– মহাদেব সাহা
হয়তো আজই ঠিক পেয়ে যাবো একটা লুফে নেয়ার মতো
সুসংবাদ
একটা কিছু অনবদ্য নীল খামে;
অনেকদিন পর আজ হয়তো ঠিকই পেয়ে যাবো সেই চিঠিখানি
সেই পাখির শিস, ফুলের হৃদ্যতা, সেই আঙুলের ছাপ
আজ ঠিকইপেয়ে যাবো একটা কিছু চমৎকার প্রাঞ্জল সংবাদ!
কতোকাল কোথাও পাইনে কোনো সুখবর,
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নব্ ইথারের রাজ্যে শুধু শুনি দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ
মহামারী-
পোর্ট স্ট্যানলীতে যুদ্ধ থামতে না থামতেই দেখি
আক্রান্ত বৈরুত ;
দেখি মারণাস্ত্র, নিউট্রন বোমার হুঙ্কার
আজ তাই মআমাকে পেতেই হবে একটা কোনো রম্য সুসংবাদ।
কারো কাছ থেকে পাইনে একটাও কোনো আনন্দ-সংবাদ,
একটিও হার্দ্য টেলিফোন, রোমাঞ্চকর বার্তা কোনো
এমন সংবাদ আর পাইনে কখনো যা কিনা মুহূর্তে ঠিক
করে তোলে আরক্তিম গাঢ় উচ্ছসিত ;
পৃথিবীর সবকিছু পাওয়াও যার কাছে তুচ্ছ মনে হয়।
কতোকাল কোথঅও আমার জন্য একটিও সুসংবাদ নেই
খাম খুলে দেখি কালো বিষণ্ন অক্ষরগুলো
একটা না একটা কিছু দুঃসংবাদ নিয়ে বসে আছে
ঘরে এসে দুঃসংবাদ ছাড়া আর কিছুই মুনি না
এমনকি রেডিওর উত্তেজিত নবে আঙুল রাখতেই শুনি
বেজে ওঠে খাঁখাঁ দুঃসংবাদ,
আবার কলিংবেল বাজিয়েও দুঃসংবাদ ঢুকে পড়ে ঘরে
আজ তাই যেভাবেই হোক একটা কোনো সুসংবাদ চাই,
তুমুল, গভীর একটা কোনো উষ্ণ সুসংবাদ।
======================================================– মহাদেব সাহা
হয়তো আজই ঠিক পেয়ে যাবো একটা লুফে নেয়ার মতো
সুসংবাদ
একটা কিছু অনবদ্য নীল খামে;
অনেকদিন পর আজ হয়তো ঠিকই পেয়ে যাবো সেই চিঠিখানি
সেই পাখির শিস, ফুলের হৃদ্যতা, সেই আঙুলের ছাপ
আজ ঠিকইপেয়ে যাবো একটা কিছু চমৎকার প্রাঞ্জল সংবাদ!
কতোকাল কোথাও পাইনে কোনো সুখবর,
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নব্ ইথারের রাজ্যে শুধু শুনি দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ
মহামারী-
পোর্ট স্ট্যানলীতে যুদ্ধ থামতে না থামতেই দেখি
আক্রান্ত বৈরুত ;
দেখি মারণাস্ত্র, নিউট্রন বোমার হুঙ্কার
আজ তাই মআমাকে পেতেই হবে একটা কোনো রম্য সুসংবাদ।
কারো কাছ থেকে পাইনে একটাও কোনো আনন্দ-সংবাদ,
একটিও হার্দ্য টেলিফোন, রোমাঞ্চকর বার্তা কোনো
এমন সংবাদ আর পাইনে কখনো যা কিনা মুহূর্তে ঠিক
করে তোলে আরক্তিম গাঢ় উচ্ছসিত ;
পৃথিবীর সবকিছু পাওয়াও যার কাছে তুচ্ছ মনে হয়।
কতোকাল কোথঅও আমার জন্য একটিও সুসংবাদ নেই
খাম খুলে দেখি কালো বিষণ্ন অক্ষরগুলো
একটা না একটা কিছু দুঃসংবাদ নিয়ে বসে আছে
ঘরে এসে দুঃসংবাদ ছাড়া আর কিছুই মুনি না
এমনকি রেডিওর উত্তেজিত নবে আঙুল রাখতেই শুনি
বেজে ওঠে খাঁখাঁ দুঃসংবাদ,
আবার কলিংবেল বাজিয়েও দুঃসংবাদ ঢুকে পড়ে ঘরে
আজ তাই যেভাবেই হোক একটা কোনো সুসংবাদ চাই,
তুমুল, গভীর একটা কোনো উষ্ণ সুসংবাদ।
---মেঘ দেখার দুঃখ, গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা
– মহাদেব সাহা
কী করে বলি এই মেঘ দেখর দুঃখ, এই গোলাপ দেখার
ব্যাকুলতা-
কিন্তু আমিও যখন মেঘের দিকে তাকাই দেখি কালিদাসই
দেখছেন বিরহী যক্ষকে,
হঠাৎ মন ভরে যায় বহু যুগের ওপার থেকে আসা বর্ষণে:
এই গোলাপ দেখর কথা আমার হয়তো বলাই হবে না
কিন্তু যখান গোলাপের দিকে তাকাই দেখি ব্রেক
তাকিয়ে আছেন গেলোপের রুগ্নতার দিকে,
কিংবা রিলকে আয়ত্ত করে চলেছেন একটি শ্বেতগোলাপ,
কী করে বলি এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!
মেঘ দেখতে দেখতে আমি যে কখন মেঘদূতের ভেতর ডুবে যাই,
বিরহকাতর যক্ষের জন্য ভারী হয়ে ওঠে এই বুক
কিংবা গোলাপের দিকে তাকাতেই চোখে ভেসৈ ওঠে
রিলকের মুখটি,
এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা
কাউকে বলাই হবে না ;
আমি যখন এই প্রকৃতির দিকে তাকাই দেখি রবীন্দ্রনাথ
দেখছেন প্রকৃতির নীলাম্বরী
সেই ব্যকুল বসন্তে আমারও দুচোখ জলে ভরে যায় -
এই মেঘ, এই গোলাপ আমারও অলিখিত কবিতা।
যখন মানুষের সুদ্ধতার কথা ভাবি দেখি দাঁড়িয়ে আছেন
ব্যথিত বোদলেয়ার
শহরের রাত্রির দিকে তাকালে মনে হয় জীবনানন্দ দাশ দেখছেন
লিবিয়ার জঙ্গল,
যখন একজন বিপ্লবীর দিকে তাকাই দেখি দুচোখে
মায়াকোভস্কির স্বপ্ন
আর্ত স্বদেশের দিকে তাকিয়ে আমিও নেরুদার কথাই ভাবি,
কেউ জানে না একটি ফুলের মৃত্যু দেখে, একটি পাখির ক্রন্দন দেখে
আমারও হৃদয় পৃথিবীর আহত কবিদের মতোই হাহাকার
করে ওঠে।
একটি ফুল দেখে আমিও একজন প্রেমিকের মতোই পরাজিত
হতে ভালোবাসি
একটি ঝরাফুলের দুঃখ বুকে নিয়ে যে-কোনো ব্যথিত কবির
মতোই সারাদনি ঘুরে বেড়াই,
আসলে সে-কথাগুলোই বলা হয়নি, বলা হয়নি;
মানুষের সমাজে এই বৈষম্য দেখে আমিও একজন
বিপ্লবীর মতোই শ্রেনীসংগ্রামের জন্য তৈরি হই,
এই জরা বার্ধক্য দেখে কতোবার বুদ্ধের মতোই
ব্যথিত হয়ে উঠি;
কিন্তু কী করে বলবো এইসব মেঘ দেখার দুঃখ, এইসব
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!
=============================================================
--এই জীবনে
– মহাদেব সাহা
এই জীবনে হবে না আর মূলে যাওয়া,
চুড়োয় ওঠা-
কাটবে জীবন পাদদেশে, পাদমূলে;
খুব ভেতরে প্রবেশ করা হবে না আর এই জীবনে
হবে না আর ভেতর মধু ফের আহরণ,
হবে শুধুই ওপর ছোঁয়া, ওপর দেখা।
এই জীবনে হবে না আর তোমার নিবিড়
স্পর্শ পাওয়া,
হবে না এই নদী দেখা, জলাশয়ের
কাছে যাওয়া,
একটিবার তোমায় নিয়ে হ্রদের জলে একটু নামা-
হবে না আর পৌঁছা মোটেই ডুব-সাঁতারে
জলের গহীন তলদেশে,
জলে নামা, সাঁতার শেখা;
মূলের সঙ্গে হবে না আর ঠিক পরিচয়
মাত্র এখন অনুবাদের অর্ধ স্বাদেই তৃপ্ত থাকা,
এই জীবনে হবে না আর আকাশ দেখা,
চিবুক ছোঁয়া-
তোমায় নিয়ে নীল পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া;
এই জীবনে হবে না আর তোমার গোপন দেখা পাওয়া,
একন শুধু চোখের জলে দুঃখ পাওয়া,
নিজের মাঝেই ফুরিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া।
এই জীবনে হবে না আর দুঃখ কারো
মোচন করা,
কারো অশ্রু মুছিয়ে দেয়া সাঁকো বাঁধা,
কারো ক্ষত সারিয়ে তোলা;
এই জীবনে হবে না আর মুগ্ধ ভ্রমণ,
কারো ক্ষত সারিয়ে তোলা;
এই জীবনে হবে না আর মুগ্ধ ভ্রমণ,
মূলে যাওয়া-
তোমায় ছোঁয়া।
===================================================
--এই জীবন
- মহাদেব সাহা-
এই একরত্তি জীবনে বলো না কীভাবে সম্ভব ভালোবাসা
তার জন্য চাই আরো দীর্ঘ অনন্ত জীবন,
ভালোবাসা কীভাবে সম্ভব, অতিশয় ছোটো এ জীবন
একবার প্রিয় সম্বোধন করার আগেই
শেষ হয় এই স্বল্প আয়ু-
হয়তো একটি পরিপূর্ণ চুম্বনেরও সময় মেলে না
করস্পর্শ করার আগেই নামে বিচ্ছেদের কালো যবনিকা;
এতো ছোটো সামান্য জীবনের কীভাবে হবেই ভালোবাসা
ভালোবাসি কথাটি বলতেই হয়তোবা কেটে যাবে সমস্ত জীবন,
হয়তোবা তোমার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই
লেগে যাবে অনেক বছর
হয়তো তোমার কাছে একটি প্রেমের চিঠি লিখতেই
শেষহয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ নিদ্রাহীন রাত;
তোমার সম্মুখে বসে প্রথম একটি শব্দ উচ্চারণ করতেই
শেষ হয়ে যাবে কতো কৈশোর-যৌবন,
ঘনাবে বার্ধক্য, কেশরাজি উড়াবে মাথায়
সেই ধূসর পতাকা;
এইটুকু ছোট্ট জীবন, এখানে সম্ভব নয় ভালোবাসা
তার জন্য চাই আরো অনেক জীবন, অনন্ত সময়
তোমাকে ভালোবাসার জন্য জানি তাও খুবই স্বল্প ও সংক্ষিপ্ত মনে হবে।
===================================================
---ঘুমোবার আগে
--- আবুল হাসান
আমার কাছে আগুন ছিলো না
আমি চাঁদের আগুনে
শাদা সিগ্রেট জ্বালিয়ে বসেছিলাম কুয়াশায়!
-কে ওখানে?
শীতরাতে পৌষ-পাখির গলা শোনা গেলো জ্যোত্স্নায়,
-কে ওখানে?
পাখির কন্ঠের গানে
কুয়াশায় আমি কালো জ্যোত্স্না ঘুরে হঠাত্ তখন
চাঁদের আগুনে পুড়ে
ছুঁয়ে দিতে উদ্যত হলাম!
অপসৃয়মাণ তুমি?
তোমাকে না ছুঁতে পেরে
আমি নিজ নিয়তির অন্তর্গত রোদনকে বললাম, দেখো
আমি আর কাঁদতে পারবো না !...
==========================================
চাই না কোথাও যেতে
- মহাদেব সাহা---যদুবংশ ধ্বংসের আগে
আমি তো তোমাকে ফেলে চাই না কোথাও যেতে
পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা মনোরম স্থানে,
সমুদ্র-সৈকতে, স্বর্ণদ্বীপে-
স্বপ্নেও শিউরে উঠি যখন দেখতে পাই
ছেড়ে যাচ্ছি এই মেঠো পথ, বটবৃক্ষ, রাখালের
বাঁশি, হঠাৎ আমার বুকে আছড়ে পড়ে পদ্মার ঢেউ
আমার দুচোখে শ্রাবণের নদী বয়ে যায়;
যখন হঠাৎ দেখি ছেড়ে যাচ্ছি সবুজ পালের নৌকো,
ছেড়ে যাচ্ছি ঘরের মেঝেতে আমার মায়ের আঁকা
সারি সারি লক্ষ্মীর পা
বোবা চিৎকারে আর্তকণ্ঠে বলে উঠি হয়তো
তখনই-
তোমার বুকের মধ্যে আমাকে লুকিয়ে রাখো
আমি এই মাটি ছেড়ে, মাটির সান্নিধ্য ছেড়ে,
আকাশের আত্মীয়তা ছেড়ে,
চাই না কোথাও যেতে, কোথাও যেতে
=======================================
~মুনাজাত
~কাজী নজরুল ইসলাম
আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে
বাঁচাও প্রভু উদার।
হে প্রভু! শেখাও - নীচতার চেয়ে
নীচ পাপ নাহি আর।
যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,
যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,
জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-
ক্ষমা নাহি নীচতার।।
ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার
হৃদয়ের পরিসর,
যেন সম ঠাঁই পায়
শত্রু-মিত্র-পর।
নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো
অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,
কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী
ক্ষুদ্র আত্মা তার।।
==============================~কাজী নজরুল ইসলাম
আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে
বাঁচাও প্রভু উদার।
হে প্রভু! শেখাও - নীচতার চেয়ে
নীচ পাপ নাহি আর।
যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,
যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,
জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-
ক্ষমা নাহি নীচতার।।
ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার
হৃদয়ের পরিসর,
যেন সম ঠাঁই পায়
শত্রু-মিত্র-পর।
নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো
অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,
কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী
ক্ষুদ্র আত্মা তার।।
- মানুষ
-- কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সল কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
'পূজারী, দুয়ার খোল,
ক্ষুদার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!'
স্বপ্ন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ'য়ে যাবে নিশ্চয়!
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুদায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, 'দ্বার খোল বাবা, খাইনি তো সাত দিন!'
সহসা বন্ধ হ'ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুদার মানিক জ্বলে!
ভুখারী ফুকারি' কয়,
'ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমারনয়!'
মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে-আজারির চিন্
বলে 'বাবা, আমি ভুকা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!'
তেরিয়াঁ হইয়া হাঁকিল মোল্লা -"ভ্যালা হ'ল দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?"
ভুখারী কহিল, 'না বাবা!' মোল্লা হাঁকিল - তা' হলে শালা
সোজা পথ দেখ!' গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
"আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুদার অন্ন তা'বলে বন্ধ করোনিপ্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!"
============================================
~কাজী নজরুল ইসলাম
খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট শিশুর আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
শূণ্যে মহা আকাশে
তুমি মগ্ন লীলা বিলাসে
ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
তারকা রবি শশী
খেলনা তব হে উদাসী
পড়িয়া আছে রাঙা
পায়ের কাছে রাশি রাশি।
নিত্য তুমি হে উদার
সুখে-দুখে অবিকার।
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন সনে
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
~এক আল্লাহ জিন্দাবাদ
~কাজী নজরুল ইসলাম
উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।
উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই;
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!
ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে,
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে।
ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে,
ওরা জিন, প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে।
মোরা বাংলার নব যৌবন,মৃত্যুর সাথে সন্তরী,
উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি।
মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী,
অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী।
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি।
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি।
উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার,
ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুলবাহার!
আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব
ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব।
হুতুম প্যাচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়,
কাকে আর তাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়।
বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি;
তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি।
তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে এক সাথে,
নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধুলির দুনিয়াতে।
সাত আসমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়,
আল্লা নিত্য মহাদানী প্রভূ, যে যাহা চায়, সে তাহা পায়।
যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই,
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই।
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মেরা আল্লার রাজ্য চাই,
দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই।
মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভূ মোদের,
শকুন শিবার মত কাড়াকাড়ি করে শবে লয়ে-- শখ ওদের!
আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভূ,
নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভূ।
পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক, ভালো হোক ভালো,
এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো।
সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে,
তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে।
দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী, তারা গুন্ডাদল
তারা দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল।
ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ চায়,
ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!
তাড়াবে এদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা,
এরাই বৈশ্য, ফসল শৈস্য লুটে খায়, এরা চির চেনা।
ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ,
পর ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর ঢেউ।
বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিঃশ্বাসে দিনে রাতে,
হবে দুলদুল - আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে।
আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন,
তাহারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন।
নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান
সর্ব-ক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান!
ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে - ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ,
মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব - "এক আল্লাহ জিন্দাবাদ"।
===================================================
শুদ্ধ করো আমার জীবন
~মহাদেব সাহা
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন,
আমি প্রতিটি ভোরের
মতো
আবার নতুন হয়ে উঠি,
হই সূর্যোদয়
আমার জীবন তুমি পরিশুদ্ধ করো,
আমি প্রস্ফুটিত হই
আমি বহুদিন ঝরা ব্যথিত বকুল অন্ধকারে,
আমি বহুদিন
বিষন্ন বিধুর ;
একবার আমার মাথায় হাত রাখো, সুপ্রসন্ন হও
এই দগ্ধ বুকে করো শ্রাবণের অঝোর বর্ষণ
আমি শ্যামল সবুজ বৃক্ষ হয়ে উঠি ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি হই
সূর্যোদয়,
আমি হই উদিত আকাশ
আমি হয়ে উঠি প্রতিটি শিশুর হাতে প্রথম
বানান
শেখা বই,
হয়ে উঠি ভোরবেলাকার পাখিদের গান ;
আমার জীবন তুমি শুদ্ধ করো, আমি হই নতুন
সবুজ
কোনো দ্বীপ,
আমি হই বর্ষাকাল, আমি হই বরষার নব
জলধারা
আমি বহুদিন ব্যথিত বিষাদ, আমি বহুদিন একা
ঝাউবন ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন,
আমি হয়ে উঠি সদ্যফোটা ফুল
আমি হয়ে উঠি সকালের ঘুমভাঙ্গা চোখ ।
===========================================
কতদিন দেহিনা মায়ের মুখ
হুনিনা সেই কোকিল নামের কালা পাহির গান
হায়রে পরান, হায়রে পরান।।
হায়রে আমার গাঁয়ের বাড়ি
সারি সারি গরুর গাড়ি
মরা নদীর চর।
দীঘির জলে হাসের খেলা
ঘরের চালে দুপুর বেলা
রঙ্গিলা কইতর।।
উঠানে চরাইনা সোনার ধান
হায়রে পরান, হায়রে পরান ।
কতদিন ধরিনা ডোবায় মাছ
করিনা সেই মরা নদীর মিঠা পানি পান
হায়রে পরান, হায়রে পরান ।
হায়রে আমার রখাল হিয়া
কাজলা গরুর গোসল দিয়া
মাঠে নিয়া যায়।
বিহাল বেলা বাঁশের বনে
ঝিকিমিকি রইদের সনে
মন মিলাইতে চায়।।
ভুলিতে পারেনা মাটির টান
হায়রে পরান, হায়রে পরান।
কতদিন রাহিনা চানের খোজ
দেহিনা সেই তারার চোখে মিছা অভিমান
হায়রে পরান, হায়রে পরান।
হায়রে পরান, হায়রে পরান।
হায়রে পরান, হায়রে পরান।
হায়রে পরান, হায়রে পরান।।
===================================
"নাবালিকা একটু সামলে থেকো"
............................................................
- জিহান আল হামাদী
নাবালিকা একটু সামলে থেকো
শিশিরের ওহমে কাঁটা আছে,
ভয় পেয়ো না, কাঁটা ছোঁবে না তোমায়
আমার পায়ে তোমার পা রেখে
বাড়ি পৌঁছে দেবো,
কাঁটা সরে যাবে সব
তুমি উড়ে যেও সাঁঝের কবুতরের মত ।।
তোমার উড়ে যাওয়া নিয়ে কোন ভয় নেই
যেতে চাইলে যেতে পারো যখন খুশি,
তুমি তো আর বনের পাখি নও যে বেঁধে রাখবো !
বাঁধাধরা নিয়মের ভালবাসায় আমি বিশ্বাসী নই,
ছেড়ে যদি চলে যাও কোনদিন, তুমি ভয় পেয়ো না
পাশেই পাবে নাবালিকা, তোমার হৃদয়ে আমি আছি-
নিজেও হয়তো জানো না,
তোমার ওই অজানা অনুভূতি নিয়েই আমার যত ভয় !!
হাসছো তুমি ! খবরদার ! ওভাবে হাসবে না !
শব্দ হারিয়ে ফেলি আমি,
পৃথিবীর সমস্ত বর্ণমালা শুধু তোমার নাম জপতে থাকে-
নাহ ! তুমি হেসো, চুল মেলে হেসো,
চোখের কাজল গড়িয়ে পড়ুক আনন্দ হয়ে ।
দুঃখ ? ভয় পেয়ো না তুমি-
ওসব তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না
নাবালিকা, তোমার হাজার বছরের পুরানো ছায়া হবো ।
নাবালিকা একটু সামলে থেকো-
বয়স তোমার মন-উচাটন,
ভুলের পথে হোঁচট খেয়ে কষ্ট পেয়ো না;
সমস্যা নেই, আমি তোমায় শুধরে দেবো
তোমার কষ্ট পাওয়া নিয়েই আমার যত ভয় !
আজ থেকে আমার থেকো
তোমার হাজার বছর পুরানো সিঁদুর হতে চাই ।।
"নাবালিকা একটু সামলে থেকো"
............................................................
- জিহান আল হামাদী
নাবালিকা একটু সামলে থেকো
শিশিরের ওহমে কাঁটা আছে,
ভয় পেয়ো না, কাঁটা ছোঁবে না তোমায়
আমার পায়ে তোমার পা রেখে
বাড়ি পৌঁছে দেবো,
কাঁটা সরে যাবে সব
তুমি উড়ে যেও সাঁঝের কবুতরের মত ।।
তোমার উড়ে যাওয়া নিয়ে কোন ভয় নেই
যেতে চাইলে যেতে পারো যখন খুশি,
তুমি তো আর বনের পাখি নও যে বেঁধে রাখবো !
বাঁধাধরা নিয়মের ভালবাসায় আমি বিশ্বাসী নই,
ছেড়ে যদি চলে যাও কোনদিন, তুমি ভয় পেয়ো না
পাশেই পাবে নাবালিকা, তোমার হৃদয়ে আমি আছি-
নিজেও হয়তো জানো না,
তোমার ওই অজানা অনুভূতি নিয়েই আমার যত ভয় !!
হাসছো তুমি ! খবরদার ! ওভাবে হাসবে না !
শব্দ হারিয়ে ফেলি আমি,
পৃথিবীর সমস্ত বর্ণমালা শুধু তোমার নাম জপতে থাকে-
নাহ ! তুমি হেসো, চুল মেলে হেসো,
চোখের কাজল গড়িয়ে পড়ুক আনন্দ হয়ে ।
দুঃখ ? ভয় পেয়ো না তুমি-
ওসব তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না
নাবালিকা, তোমার হাজার বছরের পুরানো ছায়া হবো ।
নাবালিকা একটু সামলে থেকো-
বয়স তোমার মন-উচাটন,
ভুলের পথে হোঁচট খেয়ে কষ্ট পেয়ো না;
সমস্যা নেই, আমি তোমায় শুধরে দেবো
তোমার কষ্ট পাওয়া নিয়েই আমার যত ভয় !
আজ থেকে আমার থেকো
তোমার হাজার বছর পুরানো সিঁদুর হতে চাই ।।
======================================
-সামুদ্রিক প্রেম
__ নির্মলেন্দু গুণ
আমার প্রেম ছিলো সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের মতো,
তুমি চেয়েছিলে কবিতাপ্রধান প্রেম ।
তাই, বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে
লঘু হয়ে আসা নিম্নচাপ যেরকম
শান্তরূপে অতিক্রম করে উপকূল-
তেমনি কোনো ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়াই
আমার প্রেম অতিক্রম করেছে তোমাকে ।
তা না হলে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের মতো চোখের পলকে
সে তছনছ করে দিতে পারতো
তোমার সাজানো সংসার, গাছপালা, ঘরবাড়ি ।
সে পারতো তোমাকে চিত্রল হরিণীর মতো
গভীর গভীরতর সমুদ্রে ভাসিয়ে নিতে-
যেখানে চিত্রল হরিনীর সাথে চূড়ান্ত সঙ্গমে মাতে
ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ।
শুধু তোমার জন্য, শুধু তোমার কথা ভেবে,
সমুদ্রের নাভি থেকে জাগ্রত আমার অশান্ত প্রেমকে
আমি শান্ত সন্তের মতো তোমার সন্ত্রস্ত উপকূল
অতিক্রম করতে বলেছি ।
তোমাকে সে প্রদক্ষিণ করেছে, হজ্বযাত্রীরা যে রকম
শান্ত নগ্ন পায়ে প্রদক্ষিণ করে পবিত্র কাবাঘর ।
তোমার জন্য প্রেমকে আমি পরিণত করেছি কবিতায় ।
তাতে লাভ হয়েছে পাঠকের এবং তোমার ।
কিন্তু তার জন্য আমাকে কি করতে হয়েছে, জানো ?
এপ্রিলের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতো
তোমার উপকূলের দিকে ছুটে-যাওয়া
আমার আবেগের ঢেউগুলোকে পুনরায় মধ্যসমুদ্রের দিকে
ফেরত পাঠাতে গিয়ে আমি রত্নাকর দস্যুর গায়ে
পরিয়েছি বাল্মীকির বেশ ।
তুমি তোমার দুরন্ত ছেলেটির গায়ের
জামা বদল করার সময় নিশ্চয়ই বুঝবে,
কাজটা কবিতা লিখার মতো সহজ ছিল না ।
==========================================
আবার আসিব ফিরে
-- জীবনানন্দ দাশ
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শাঁখচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিঁকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হবো - কিশোরীর - ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলারি সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে।
হয়তো খৈয়ের ধান সরাতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদাছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায় - রাঙ্গা মেঘে সাঁতরায়েঅন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে,
দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।
===========================================
আমাকে একটি কথা দাও
__________জীবনানন্দ দাশ
আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো
সহজ মহৎ বিশাল,
গভীর; - সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে
মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,
আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।
সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:
সেই দিনের - আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন
সেই উজ্জ্বল পাখিনীর - পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে
অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।
=====================================
--দূরে আছো দূরে
--- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
তোমাকে পারিনি ছুঁতে, তোমার তোমাকে-
উষ্ণ দেহ ছেনে ছেনে কুড়িয়েছি সুখ,
পরস্পর খুড়ে খুড়ে নিভৃতি খুঁজেছি।
তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।
যেভাবে ঝিনুক খুলে মুক্ত খোঁজে লোকে
আমাকে খুলেই তুমি পেয়েছো অসুখ,
পেয়েছো কিনারাহীন আগুনের নদী।
শরীরের তীব্রতম গভীর উল্লাসে
তোমার চোখের ভাষা বিস্ময়ে পড়েছি-
তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।
জীবনের ’পরে রাখা বিশ্বাসের হাত
কখন শিথিল হয়ে ঝ’রে গেছে পাতা।
কখন হৃদয় ফেলে হৃদপিন্ড ছুঁয়ে
বোসে আছি উদাসীন আনন্দ মেলায়-
তোমাকে পারিনি ছুঁতে-আমার তোমাকে।
ক্ষাপাটে গ্রীবাজ যেন, নীল পটভূমি
তছ নছ কোরে গেছি শান্ত আকাশের।
অঝোর বৃষ্টিতে আমি ভিজিয়েছি হিয়া-
তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।।
======================================
--লোকে যাকে প্রেম নাম কহে
--- আল মাহমুদ
এই গতির মধ্যে মনে হয় কি যেন একটা স্থির হয়ে থাকে।
আমাদের চারিদিকে যখন কোনো গতিকেই আমরা থামাতে পারছি না।
সবকিছুই, না কলম না চিন্তা, এমন কি দীর্ঘজীবী বিপ্লবও
মুখ থুবড়ে দ্রুত পেছনে হটে গিয়ে ক্রেনের আংটাকে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে–
মহামতি অনড় লেনিনের মূর্তের গলায় উপড়ে ফেলার শিকল পরাতে।
তখন কেন মনে হবে এমন একটা কিছু আছে যা টলছে না?
দ্যাখো তোমার মেয়েটিকে দ্যাখো, দুদিন আগেও যে
কাঁটা বেছে না দিলে সরষে দেয়া পদ্মার ইলিশ পর্যন্ত মুখে তুলতে পারতো না
এখন সে প্রেমের সাথে সাক্ষাতের জন্য উত্তর গোলার্ধের উত্তর প্রান্তে
একাকী উড়াল দিতে টিকেট হাতে নাচছে।
কত দ্রুত আমাদের হাত গলে বেরিয়ে যাওয়া শিশুরা
বিশ্বের ভারসাম্যের দিকে ঘাড় নুইয়ে দৌড়ে গেল। আর আমরা ভাবলাম
গতিই জীবন।
গতিই যদি জীবন তবে তোমার আমার মধ্যে সুস্থিরতা কি আর অবশিষ্ট থাকে?
এখন তুমি একটা চাদরে নকশা তুলছ। আর আমি দেখছি
তোমার সর্বাঙ্গে লাবণ্যের ঘামে স্থির ছায়ার স্থবিরতা।
তোমার আত্মার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে তোমার অমৃতের আধার দুটি।
যা সন্তানের লেহনে, পানে আর তৃপ্তিতে অফুরন্ত।
ও আমার অবাধ্য দৃষ্টি, তুমি স্থিরতার বেদীর ওপর
এই বিশ্বময়ীকে দ্যাখো। লোকে যাকে সুখে ও যন্ত্রণায়
প্রেম নাম কহে।
=====================================
---জীবনের হিসাব
_____সুকুমার রায়
বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই চড়ি শখের বোটে
মাঝিরে কন, “বলতে পারিস সূর্য কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফেলফেলিয়ে হাসে,
বাবু বলেন, “সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি!”
খানিক বাদে কহেন বাবু, “বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় হতে নেবে?
বলত কেন লবন পোরা সাগর ভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, “আরে মশাই অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, “এই বয়সে জানিসনেও তা কি?
জীবনটা তোর নেহাত খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!”
আবার ভেবে কহেন বাবু, “বলত ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চূড়ো?
বলত দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহন লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলেন, “আমায় কেন লজ্জা দিছেন হেন?”
বাবু বলেন, “বলব কি আর বলব তোরে কি, তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন নৌকাখানি ডুবল বুঝি দুলে।
মাঝিরে কন, “একি আপদ ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবল নাকি নৌকো এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, “সাতার জানো?” মাথা নারেন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, “মশাই এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে।
======================================
--মজার দেশ
_________-যোগীন্দ্রনাথ সরকার
এক যে আছে মজার দেশ,
সব রকমে ভালো ,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ ,
দিনে চাঁদের আলো ।
আকাশ সেথা সবুজ বরন
গাছের পাতা নীল ,
ডাঙায় চরে রুই কাতলা
জলের মাঝে চিল !
সেই দেশেতে বেড়াল পালায় ,
নেংটি-ইঁদুর দেখে ;
ছেলেরা খায় ক্যাস্টর-অয়েল-
রসগোল্লা রেখে !
মন্ডা-মিঠাই তেতো সেথা ,
ওষুধ লাগে ভালো ;
অন্ধকারটা সাদা দেখায় ,
সাদা জিনিষ কালো !
ছেলেরা সব খেলা ফেলে
বই নিয়ে বসে পড়ে ;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া
লোকের পিঠে চড়ে ;
ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই ,
উড়তে থাকে ছেলে ;
বরশি দিয়ে মানুষ গাঁথে ,
মাছেরা ছিপ ফেলে ;
জিলিপি সে তেরে আসে ,
কামড়ে দিতে চায় !
কচুরি আর রসগোল্লা
ছেলে ধরে খায় !
পায়ে ছাতা দিয়ে লোকে
হাতে হেঁটে চলে !
ডাঙায় ভাসে নৌকা জাহাজ ,
গাড়ি ছোটে জলে !
মজার দেশের মজার কথা
বলবো কত আর ;
চোখ খুললে যায় না দেখা
মুদলে পরিষ্কার ।
===================================
--সৃষ্টি সুখের উল্লাসে (আমাদের পেইজ বন্ধু )
হঠাৎ করে গোধূলি বেলায়
ডাক পাঠালে,
আমি সকল জড়তা
ভেঙেই তোমাকে
বলেছিলাম
"কেমন আছো? "
তখনো সূর্য দীপ্তিমান ছিল তুমি জানতে
চেয়েছিলে
কি আমার অভিপ্রায়?
আচ্ছা বলতো
কত দিন পরে হল
আবার দেখা?
কত বসন্ত আসে আর যায়!
কতশত অভিমান
আজো দরজায় এসে কড়া নাড়ে!
যে ব্যথা দুজনকে
সমান ভাবে রাঙায়
তোমার খেয়ালী মন ~~~~~
যতবার কাছে যাব
বলে ঠিক করি ~~
ততবারই তুমি
নিজেকে গোপণ কর -----
তুমি নিরুত্তর!
এমনভাবে তাকিয়ে থাকো
যেন আমায় প্রথম দেখছো!!! এইভাবে আর কতদিন গত হবে?? দুজনে মুখোমুখি বসে থাকি, হাতের পরে হাত রাখি
তোমার মুখে হাতের একটু
আলতো পরশ বুলিয়ে দিই ~~~
আমার ভীষণ ইচ্ছে করে!!! কিন্তু বল এই আছি
আর এই নেই,
জীবনের কয়টি ইচ্ছেই বা পুরণ হয়! সেই তুমি আর সেই আমি প্রতিক্ষায় থাকি
কবে আসবে সেই কালবেলা??? বিদায় ক্ষণে
তুমি বলে গেলে ভালোথেকো..ভালোথেকো....!!!
আর আমি তোমার
পথ পানে চেয়ে থাকি..............
======================================
- মানুষ
-- কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সল কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
'পূজারী, দুয়ার খোল,
ক্ষুদার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!'
স্বপ্ন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ'য়ে যাবে নিশ্চয়!
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুদায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, 'দ্বার খোল বাবা, খাইনি তো সাত দিন!'
সহসা বন্ধ হ'ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুদার মানিক জ্বলে!
ভুখারী ফুকারি' কয়,
'ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমারনয়!'
মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে-আজারির চিন্
বলে 'বাবা, আমি ভুকা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!'
তেরিয়াঁ হইয়া হাঁকিল মোল্লা -"ভ্যালা হ'ল দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?"
ভুখারী কহিল, 'না বাবা!' মোল্লা হাঁকিল - তা' হলে শালা
সোজা পথ দেখ!' গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
"আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুদার অন্ন তা'বলে বন্ধ করোনিপ্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!"
===================================
নক্সী কাঁথার মাঠ - এক
-- জসীমউদ্দীন
(এক)
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী,
উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি |
--- রাখালী গান
এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও --- মধ্যে ধু ধু মাঠ,
ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ|
এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা, হেথায় হোথায় গাছ ;
গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলি সব দাঁড়ায় তারি পাছ |
ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল কায়া,
ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় বনের মায়া |
এ-গাঁও চেয়ে ও-গাঁর দিকে, ও-গাঁও এ-গাঁর পানে,
কতদিন যে কাটবে এমন, কেইবা তাহা জানে!
মাঝখানেতে জলীর বিলে জ্বলে কাজল-জল,
বক্ষে তাহার জল-কুমুদী মেলছে শতদল |
এ-গাঁর ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে,
জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে!
কেউবা বলে --- আদ্যিকালের এই গাঁর এক চাষী,
ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি ;
এ-পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে,
ও-গাঁর মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে!
এইখানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়,
জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায়ে |
কেইবা জানে হয়তো তাদের মাল্য হতেই খসি,
শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি |
মাঠের মাঝের জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ,
জ্বলছে যেন এ-গাঁর ও-গাঁর বিরহেরি দীপ !
বুকে তাহার এ-গাঁর ও-গাঁর হরেক রঙের পাখি,
মিলায় সেথা নতুন জগৎ নানান সুরে ডাকি |
সন্ধ্যা হলে এ-গাঁর পাখি ও-গাঁর পানেধায়,
ও-গাঁর পাখি এ-গাঁয় আসে বনের কাজল ছায় |
এ-গাঁর লোকে নাইতে আসে, ও-গাঁর লোকেও আসে
জলীর বিলের জলে তারা জলের খেলায় ভাসে |
এ-গাঁও ও-গাঁও মধ্যে ত দূর --- শুধুই জলের ডাক,
তবু যেন এ-গাঁয় ও-গাঁয় নেইকো কোন ফাঁক |
ও-গাঁর বধু ঘট ভরিতে যে ঢেউ জলে জাগে,
কখন কখন দোলা তাহার এ-গাঁয় এসে লাগে|
এ-গাঁর চাষী নিঘুম রাতে বাঁশের বাঁশীর সুরে,
ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে!
এ-গাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান,
ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে বাড়ায় তখন কান |
এ-গাঁও ও-গাঁও মেশামেশি কেবল সুরে সুরে ;
অনেক কাজে এরা ওরা অনেকখানি দূরে |
এ-গাঁর লোকে দল বাঁধিয়া ও-গাঁর লোকের সনে,
কাইজা ফ্যাসাদ্ করেছে যা জানেই জনে জনে |
এ-গাঁর লোকেও করতে পরখ্ ও-গাঁর লোকেরবল,
অনেকবারই লাল করেছে জলীর বিলের জল |
তবুও ভাল, এ-গাঁও ও-গাঁও, আর যে সবুজ মাঠ,
মাঝখানে তার ধূলায় দোলে দুখান দীঘল বাট ;
দুই পাশে তার ধান-কাউনের অথই রঙের মেলা,
এ-গাঁর হাওয়ায় দোলে দেখি ও-গাঁয় যাওয়ার ভেলা |
=====================================
----শ্যামলসুন্দর
__তসলিমা নাসরিন
তোমাকে দেখলে
ইচ্ছে করে শুরু থেকে শুরু করি আমার জীবন।
তোমাকে দেখলে
ইচ্ছে করে মরে যাই, মরে গিয়ে পুন্য জল হই
কখনও তৃষ্ণার্ত হলে তুমি সেই জল যদি ছুঁয়ে দেখো।
আমার আকাশ দেব
তুমি রোদ বৃষ্টি যখন যা খুশি চাও নিয়ো
তোমার অনিদ্রা জুড়ে দেব আমি আমার মর্ফিন।
বারো বছরের মতো দীর্ঘ একটি রাত্তির দিয়ো
তোমাকে দেখার।
তুমি তো চাঁদের চেয়ে বেশি চাঁদ
তোমার জ্যোৎস্নায় চুড়ো করে খোঁপা বেঁধে
কপালে সিঁদুর দিয়ে একদিন খুব করে সাজব রমণী
তোমাকে দেখলে
ইচ্ছে করে মরে যাই। তোমার আগুনে
আমার মুখাগ্নি যদি হই, মরে আমি স্বর্গে যাব।
========================================
-সামুদ্রিক প্রেম
__ নির্মলেন্দু গুণ
আমার প্রেম ছিলো সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের মতো,
তুমি চেয়েছিলে কবিতাপ্রধান প্রেম ।
তাই, বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে
লঘু হয়ে আসা নিম্নচাপ যেরকম
শান্তরূপে অতিক্রম করে উপকূল-
তেমনি কোনো ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়াই
আমার প্রেম অতিক্রম করেছে তোমাকে ।
তা না হলে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের মতো চোখের পলকে
সে তছনছ করে দিতে পারতো
তোমার সাজানো সংসার, গাছপালা, ঘরবাড়ি ।
সে পারতো তোমাকে চিত্রল হরিণীর মতো
গভীর গভীরতর সমুদ্রে ভাসিয়ে নিতে-
যেখানে চিত্রল হরিনীর সাথে চূড়ান্ত সঙ্গমে মাতে
ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ।
শুধু তোমার জন্য, শুধু তোমার কথা ভেবে,
সমুদ্রের নাভি থেকে জাগ্রত আমার অশান্ত প্রেমকে
আমি শান্ত সন্তের মতো তোমার সন্ত্রস্ত উপকূল
অতিক্রম করতে বলেছি ।
তোমাকে সে প্রদক্ষিণ করেছে, হজ্বযাত্রীরা যে রকম
শান্ত নগ্ন পায়ে প্রদক্ষিণ করে পবিত্র কাবাঘর ।
তোমার জন্য প্রেমকে আমি পরিণত করেছি কবিতায় ।
তাতে লাভ হয়েছে পাঠকের এবং তোমার ।
কিন্তু তার জন্য আমাকে কি করতে হয়েছে, জানো ?
এপ্রিলের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতো
তোমার উপকূলের দিকে ছুটে-যাওয়া
আমার আবেগের ঢেউগুলোকে পুনরায় মধ্যসমুদ্রের দিকে
ফেরত পাঠাতে গিয়ে আমি রত্নাকর দস্যুর গায়ে
পরিয়েছি বাল্মীকির বেশ ।
তুমি তোমার দুরন্ত ছেলেটির গায়ের
জামা বদল করার সময় নিশ্চয়ই বুঝবে,
কাজটা কবিতা লিখার মতো সহজ ছিল না ।
==========================================
আবার আসিব ফিরে
-- জীবনানন্দ দাশ
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শাঁখচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিঁকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হবো - কিশোরীর - ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলারি সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে।
হয়তো খৈয়ের ধান সরাতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদাছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায় - রাঙ্গা মেঘে সাঁতরায়েঅন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে,
দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।
===========================================
আমাকে একটি কথা দাও
__________জীবনানন্দ দাশ
আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো
সহজ মহৎ বিশাল,
গভীর; - সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে
মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,
আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।
সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:
সেই দিনের - আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন
সেই উজ্জ্বল পাখিনীর - পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে
অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।
=====================================
--দূরে আছো দূরে
--- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
তোমাকে পারিনি ছুঁতে, তোমার তোমাকে-
উষ্ণ দেহ ছেনে ছেনে কুড়িয়েছি সুখ,
পরস্পর খুড়ে খুড়ে নিভৃতি খুঁজেছি।
তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।
যেভাবে ঝিনুক খুলে মুক্ত খোঁজে লোকে
আমাকে খুলেই তুমি পেয়েছো অসুখ,
পেয়েছো কিনারাহীন আগুনের নদী।
শরীরের তীব্রতম গভীর উল্লাসে
তোমার চোখের ভাষা বিস্ময়ে পড়েছি-
তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।
জীবনের ’পরে রাখা বিশ্বাসের হাত
কখন শিথিল হয়ে ঝ’রে গেছে পাতা।
কখন হৃদয় ফেলে হৃদপিন্ড ছুঁয়ে
বোসে আছি উদাসীন আনন্দ মেলায়-
তোমাকে পারিনি ছুঁতে-আমার তোমাকে।
ক্ষাপাটে গ্রীবাজ যেন, নীল পটভূমি
তছ নছ কোরে গেছি শান্ত আকাশের।
অঝোর বৃষ্টিতে আমি ভিজিয়েছি হিয়া-
তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।।
======================================
--লোকে যাকে প্রেম নাম কহে
--- আল মাহমুদ
এই গতির মধ্যে মনে হয় কি যেন একটা স্থির হয়ে থাকে।
আমাদের চারিদিকে যখন কোনো গতিকেই আমরা থামাতে পারছি না।
সবকিছুই, না কলম না চিন্তা, এমন কি দীর্ঘজীবী বিপ্লবও
মুখ থুবড়ে দ্রুত পেছনে হটে গিয়ে ক্রেনের আংটাকে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে–
মহামতি অনড় লেনিনের মূর্তের গলায় উপড়ে ফেলার শিকল পরাতে।
তখন কেন মনে হবে এমন একটা কিছু আছে যা টলছে না?
দ্যাখো তোমার মেয়েটিকে দ্যাখো, দুদিন আগেও যে
কাঁটা বেছে না দিলে সরষে দেয়া পদ্মার ইলিশ পর্যন্ত মুখে তুলতে পারতো না
এখন সে প্রেমের সাথে সাক্ষাতের জন্য উত্তর গোলার্ধের উত্তর প্রান্তে
একাকী উড়াল দিতে টিকেট হাতে নাচছে।
কত দ্রুত আমাদের হাত গলে বেরিয়ে যাওয়া শিশুরা
বিশ্বের ভারসাম্যের দিকে ঘাড় নুইয়ে দৌড়ে গেল। আর আমরা ভাবলাম
গতিই জীবন।
গতিই যদি জীবন তবে তোমার আমার মধ্যে সুস্থিরতা কি আর অবশিষ্ট থাকে?
এখন তুমি একটা চাদরে নকশা তুলছ। আর আমি দেখছি
তোমার সর্বাঙ্গে লাবণ্যের ঘামে স্থির ছায়ার স্থবিরতা।
তোমার আত্মার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে তোমার অমৃতের আধার দুটি।
যা সন্তানের লেহনে, পানে আর তৃপ্তিতে অফুরন্ত।
ও আমার অবাধ্য দৃষ্টি, তুমি স্থিরতার বেদীর ওপর
এই বিশ্বময়ীকে দ্যাখো। লোকে যাকে সুখে ও যন্ত্রণায়
প্রেম নাম কহে।
=====================================
---জীবনের হিসাব
_____সুকুমার রায়
বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই চড়ি শখের বোটে
মাঝিরে কন, “বলতে পারিস সূর্য কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফেলফেলিয়ে হাসে,
বাবু বলেন, “সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি!”
খানিক বাদে কহেন বাবু, “বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় হতে নেবে?
বলত কেন লবন পোরা সাগর ভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, “আরে মশাই অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, “এই বয়সে জানিসনেও তা কি?
জীবনটা তোর নেহাত খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!”
আবার ভেবে কহেন বাবু, “বলত ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চূড়ো?
বলত দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহন লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলেন, “আমায় কেন লজ্জা দিছেন হেন?”
বাবু বলেন, “বলব কি আর বলব তোরে কি, তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন নৌকাখানি ডুবল বুঝি দুলে।
মাঝিরে কন, “একি আপদ ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবল নাকি নৌকো এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, “সাতার জানো?” মাথা নারেন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, “মশাই এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে।
======================================
--মজার দেশ
_________-যোগীন্দ্রনাথ সরকার
এক যে আছে মজার দেশ,
সব রকমে ভালো ,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ ,
দিনে চাঁদের আলো ।
আকাশ সেথা সবুজ বরন
গাছের পাতা নীল ,
ডাঙায় চরে রুই কাতলা
জলের মাঝে চিল !
সেই দেশেতে বেড়াল পালায় ,
নেংটি-ইঁদুর দেখে ;
ছেলেরা খায় ক্যাস্টর-অয়েল-
রসগোল্লা রেখে !
মন্ডা-মিঠাই তেতো সেথা ,
ওষুধ লাগে ভালো ;
অন্ধকারটা সাদা দেখায় ,
সাদা জিনিষ কালো !
ছেলেরা সব খেলা ফেলে
বই নিয়ে বসে পড়ে ;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া
লোকের পিঠে চড়ে ;
ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই ,
উড়তে থাকে ছেলে ;
বরশি দিয়ে মানুষ গাঁথে ,
মাছেরা ছিপ ফেলে ;
জিলিপি সে তেরে আসে ,
কামড়ে দিতে চায় !
কচুরি আর রসগোল্লা
ছেলে ধরে খায় !
পায়ে ছাতা দিয়ে লোকে
হাতে হেঁটে চলে !
ডাঙায় ভাসে নৌকা জাহাজ ,
গাড়ি ছোটে জলে !
মজার দেশের মজার কথা
বলবো কত আর ;
চোখ খুললে যায় না দেখা
মুদলে পরিষ্কার ।
===================================
-স্বপ্ন ছায়া ~~~~
--সৃষ্টি সুখের উল্লাসে (আমাদের পেইজ বন্ধু )
হঠাৎ করে গোধূলি বেলায়
ডাক পাঠালে,
আমি সকল জড়তা
ভেঙেই তোমাকে
বলেছিলাম
"কেমন আছো? "
তখনো সূর্য দীপ্তিমান ছিল তুমি জানতে
চেয়েছিলে
কি আমার অভিপ্রায়?
আচ্ছা বলতো
কত দিন পরে হল
আবার দেখা?
কত বসন্ত আসে আর যায়!
কতশত অভিমান
আজো দরজায় এসে কড়া নাড়ে!
যে ব্যথা দুজনকে
সমান ভাবে রাঙায়
তোমার খেয়ালী মন ~~~~~
যতবার কাছে যাব
বলে ঠিক করি ~~
ততবারই তুমি
নিজেকে গোপণ কর -----
তুমি নিরুত্তর!
এমনভাবে তাকিয়ে থাকো
যেন আমায় প্রথম দেখছো!!! এইভাবে আর কতদিন গত হবে?? দুজনে মুখোমুখি বসে থাকি, হাতের পরে হাত রাখি
তোমার মুখে হাতের একটু
আলতো পরশ বুলিয়ে দিই ~~~
আমার ভীষণ ইচ্ছে করে!!! কিন্তু বল এই আছি
আর এই নেই,
জীবনের কয়টি ইচ্ছেই বা পুরণ হয়! সেই তুমি আর সেই আমি প্রতিক্ষায় থাকি
কবে আসবে সেই কালবেলা??? বিদায় ক্ষণে
তুমি বলে গেলে ভালোথেকো..ভালোথেকো....!!!
আর আমি তোমার
পথ পানে চেয়ে থাকি..............
======================================
- মানুষ
-- কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সল কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
'পূজারী, দুয়ার খোল,
ক্ষুদার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!'
স্বপ্ন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ'য়ে যাবে নিশ্চয়!
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুদায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, 'দ্বার খোল বাবা, খাইনি তো সাত দিন!'
সহসা বন্ধ হ'ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুদার মানিক জ্বলে!
ভুখারী ফুকারি' কয়,
'ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমারনয়!'
মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে-আজারির চিন্
বলে 'বাবা, আমি ভুকা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!'
তেরিয়াঁ হইয়া হাঁকিল মোল্লা -"ভ্যালা হ'ল দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?"
ভুখারী কহিল, 'না বাবা!' মোল্লা হাঁকিল - তা' হলে শালা
সোজা পথ দেখ!' গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
"আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুদার অন্ন তা'বলে বন্ধ করোনিপ্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!"
===================================
নক্সী কাঁথার মাঠ - এক
-- জসীমউদ্দীন
(এক)
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী,
উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি |
--- রাখালী গান
এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও --- মধ্যে ধু ধু মাঠ,
ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ|
এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা, হেথায় হোথায় গাছ ;
গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলি সব দাঁড়ায় তারি পাছ |
ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল কায়া,
ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় বনের মায়া |
এ-গাঁও চেয়ে ও-গাঁর দিকে, ও-গাঁও এ-গাঁর পানে,
কতদিন যে কাটবে এমন, কেইবা তাহা জানে!
মাঝখানেতে জলীর বিলে জ্বলে কাজল-জল,
বক্ষে তাহার জল-কুমুদী মেলছে শতদল |
এ-গাঁর ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে,
জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে!
কেউবা বলে --- আদ্যিকালের এই গাঁর এক চাষী,
ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি ;
এ-পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে,
ও-গাঁর মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে!
এইখানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়,
জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায়ে |
কেইবা জানে হয়তো তাদের মাল্য হতেই খসি,
শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি |
মাঠের মাঝের জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ,
জ্বলছে যেন এ-গাঁর ও-গাঁর বিরহেরি দীপ !
বুকে তাহার এ-গাঁর ও-গাঁর হরেক রঙের পাখি,
মিলায় সেথা নতুন জগৎ নানান সুরে ডাকি |
সন্ধ্যা হলে এ-গাঁর পাখি ও-গাঁর পানেধায়,
ও-গাঁর পাখি এ-গাঁয় আসে বনের কাজল ছায় |
এ-গাঁর লোকে নাইতে আসে, ও-গাঁর লোকেও আসে
জলীর বিলের জলে তারা জলের খেলায় ভাসে |
এ-গাঁও ও-গাঁও মধ্যে ত দূর --- শুধুই জলের ডাক,
তবু যেন এ-গাঁয় ও-গাঁয় নেইকো কোন ফাঁক |
ও-গাঁর বধু ঘট ভরিতে যে ঢেউ জলে জাগে,
কখন কখন দোলা তাহার এ-গাঁয় এসে লাগে|
এ-গাঁর চাষী নিঘুম রাতে বাঁশের বাঁশীর সুরে,
ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে!
এ-গাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান,
ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে বাড়ায় তখন কান |
এ-গাঁও ও-গাঁও মেশামেশি কেবল সুরে সুরে ;
অনেক কাজে এরা ওরা অনেকখানি দূরে |
এ-গাঁর লোকে দল বাঁধিয়া ও-গাঁর লোকের সনে,
কাইজা ফ্যাসাদ্ করেছে যা জানেই জনে জনে |
এ-গাঁর লোকেও করতে পরখ্ ও-গাঁর লোকেরবল,
অনেকবারই লাল করেছে জলীর বিলের জল |
তবুও ভাল, এ-গাঁও ও-গাঁও, আর যে সবুজ মাঠ,
মাঝখানে তার ধূলায় দোলে দুখান দীঘল বাট ;
দুই পাশে তার ধান-কাউনের অথই রঙের মেলা,
এ-গাঁর হাওয়ায় দোলে দেখি ও-গাঁয় যাওয়ার ভেলা |
=====================================
----শ্যামলসুন্দর
__তসলিমা নাসরিন
তোমাকে দেখলে
ইচ্ছে করে শুরু থেকে শুরু করি আমার জীবন।
তোমাকে দেখলে
ইচ্ছে করে মরে যাই, মরে গিয়ে পুন্য জল হই
কখনও তৃষ্ণার্ত হলে তুমি সেই জল যদি ছুঁয়ে দেখো।
আমার আকাশ দেব
তুমি রোদ বৃষ্টি যখন যা খুশি চাও নিয়ো
তোমার অনিদ্রা জুড়ে দেব আমি আমার মর্ফিন।
বারো বছরের মতো দীর্ঘ একটি রাত্তির দিয়ো
তোমাকে দেখার।
তুমি তো চাঁদের চেয়ে বেশি চাঁদ
তোমার জ্যোৎস্নায় চুড়ো করে খোঁপা বেঁধে
কপালে সিঁদুর দিয়ে একদিন খুব করে সাজব রমণী
তোমাকে দেখলে
ইচ্ছে করে মরে যাই। তোমার আগুনে
আমার মুখাগ্নি যদি হই, মরে আমি স্বর্গে যাব।
========================================
0 comments:
Post a Comment